সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্র আন্দোলন এবং এর নেতাকর্মীদের ওপর সহিংসতার প্রবাহ এক অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে অন্তত পাঁচজন শিক্ষার্থীর অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা, হত্যাচেষ্টা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা উঠে এসেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ নাগরিক সমাজের বিভিন্ন অংশ এই ঘটনাগুলোকে 'গুপ্ত হত্যা' এবং 'ষড়যন্ত্রমূলক সহিংসতা' হিসেবে আখ্যা দিয়ে তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। তারা দাবি করছে, তরুণদের কণ্ঠরোধ করে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে দুর্বল করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
এ হত্যাকান্ড গুলো এমন সময় যখন নিষিদ্ব ঘোষিত ছাত্রলীগ ‘জয় বাংলা’ ক্যাম্পেইনের ঘোষণা দিয়েছে।
ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্ট এক জুম মিটিং এ আওয়ামী ঘনিষ্ট অমি রহমান পিয়াল এবং সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন কে কথা বলতে দেখা যায়।
অমি রহমান পিয়ালকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘আমাদের জয় বাংলার এক্সটেনশন হতে হবে ওই রকম, দালালদের হত্যা করা। যে লোকগুলো টেক ব্যাক বাংলাদেশ বলে ইস্ট পাকিস্তান বা ৫৪ বছর আগে নিয়ে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। দ্যাট ইজ, খুঁজে খুঁজে; প্রতিটা গ্রাম-মহল্লায় তাদের হত্যায় একটা মিশন হওয়া উচিত। দ্যাট মিনস মেক আ মুক্তিযোদ্ধা। এই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কলেমা হচ্ছে জয় বাংলা।
অস্বাভাবিক মৃত্যু: পরিকল্পিত হত্যা নাকি দুর্ঘটনা?
জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশ নেওয়া একাধিক শিক্ষার্থীর রহস্যময় মৃত্যু নিয়ে ক্রমাগত বিতর্ক বাড়ছে।
১. সুজানা ও কাব্যের লাশ উদ্ধার
গত ১৭ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের পূর্বাচলে একটি লেকে কলেজছাত্রী সুজানা এবং কাব্য নামে দুই কিশোরের মরদেহ পাওয়া যায়। তাদের পরিবারের দাবি, দুজনই রাজনৈতিক প্রতিশোধের শিকার। সুজানার পরিবার জানিয়েছে, মৃত্যুর আগে সে বেশ কয়েকবার হুমকি পেয়েছিল। পুলিশ ঘটনাটিকে নিছক সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করলেও স্থানীয় এবং পরিবারের অভিযোগে এটিকে পরিকল্পিত হত্যা বলা হচ্ছে।
২. তাজবীর হোসেনের হত্যাকাণ্ড
১২ ডিসেম্বর ভোরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ছুরিকাঘাতে নিহত হন তাজবীর হোসেন। তিনি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র এবং অভ্যুত্থানের সময় অন্যতম সক্রিয় নেতা ছিলেন। পুলিশ ঘটনাটিকে ছিনতাইয়ের সময় ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড হিসেবে দেখালেও তাজবীরের পরিবারের ভাষ্যমতে, এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড।
৩. ওয়াজেদ সীমান্তের মৃত্যু
ওই একই দিনে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (এআইইউবি) ছাত্র ওয়াজেদ সীমান্ত ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন এবং ১৪ ডিসেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সীমান্ত তার এলাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। যদিও পুলিশ এই ঘটনায় দুইজন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে, নিহতের পরিবার এটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করেছে।
৪. জসিম উদ্দিন হত্যাকাণ্ড
চট্টগ্রামের আনন্দবাজার এলাকায় ব্যবসায়িক আধিপত্য বিস্তারের জেরে ১৮ ডিসেম্বর জসিম উদ্দিন নামে এক তরুণকে হত্যা করা হয়। যদিও পুলিশ ঘটনাটি ব্যবসায়িক বিরোধের ফল বলে দাবি করেছে, তবে স্থানীয় সূত্র জানায়, জসিম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ফলে তার হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
হামলা এবং হত্যাচেষ্টা
জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী ও নেতাদের ওপর ধারাবাহিক হামলা এবং হত্যাচেষ্টার ঘটনা প্রমাণ করে যে একটি সুসংগঠিত সহিংসতার চক্র কাজ করছে।
এসব হামলায় ছাত্রলীগ এর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের লক্ষ্য করে পরিচালিত হামলা ছাত্র-জনতার সমাজে উদ্দ্যেগের সৃষ্টি করেছে। হামলা এবং হত্যাচেষ্টা ছাড়াও নজরদারী এবং হত্যার হুমকি এক ধরণের উতকণ্ঠা তৈরি করছে।
৮ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে বান্দরবানের লামা যাওয়ার পথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের গাড়িবহরে নারায়ণগঞ্জে হামলার ঘটনা ঘটে। এই হামলায় তাদের ব্যাগ ও মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এর পাশাপাশি নেতাকর্মীদের গুরুতর আহত করা হয়। হামলার শিকার আন্দোলনকারীরা এ ঘটনাকে সংগঠিত ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন।
১৮ ডিসেম্বর রাতে ফরিদপুরের সদরপুরে নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির ছাত্র এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী কাজী সাইফুল ইসলাম (২৪)-এর ওপর দুর্বৃত্তরা অতর্কিত হামলা চালায়। তিনি গুরুতর আহত হন। তার ওপর এই আক্রমণকে তরুণ প্রজন্মকে ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
১৯ ডিসেম্বর বাগেরহাটের রামপালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়ক খালিদ হাসান নোমানের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, এ হামলায় জড়িত দুর্বৃত্তরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে তাকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।
১৪ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া পৌরসভা চত্বরে পিঠা উৎসবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ওপর ব্যাপক হামলা হয়। আন্দোলনের কুষ্টিয়া জেলা শাখার সদস্য সচিব মোস্তাফিজুর রহমান, যুগ্ম আহ্বায়ক সায়াদ ইসলাম শ্রেষ্ঠ, হুমাইরা কবির সাদিয়া, এবং মূখ্য সংগঠক এমডি বেলাল হোসেন বাঁধনসহ অনেকেই হামলার শিকার হন।
এই হামলায় অংশ নেয় ৩০-৪০ জন ছাত্রলীগকর্মী এবং স্থানীয় "আরডি এক্স বয়েজ" নামে একটি কিশোর গ্যাং। হামলাকারীদের হাতে অস্ত্র ছিল এবং হামলার পর তারা পালিয়ে যায়। অভিযুক্তদের মধ্যে আমির হামজা, স্যামসাদী, এবং প্রেমের নাম উঠে এসেছে। এই ঘটনা শুধু আন্দোলনের জন্য নয়, পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
২৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহর গাড়িবহরকে ট্রাকচাপা দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনার পর উভয়েই স্ট্যাটাস দিয়ে জানান:
"মারবা? পারবা না। আমরা আবরার ও আলিফের উত্তরসূরী। মনে রেখো-শহীদেরা মরে না।"
সারজিস ও হাসনাতের সঙ্গে থাকা আহমাদ উল্লাহ সাকিব ফেসবুকে লেখেন:
“শহীদ অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফ ভাইয়ের কবর জিয়ারত করে ফেরার পথে ট্রাকচাপা দিয়ে হত্যাচেষ্টা করা হয়। বাইক নিয়ে আটকানোর চেষ্টা করলে আমাদেরও চাপা দিতে চেয়েছিল। আল্লাহর কৃপায় বেঁচে ফিরেছি।”
এই ধারাবাহিক হামলার ঘটনা বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ছাত্র-জনতার উপর এই আক্রমণগুলো যে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তা পরিষ্কার। বরং এটি একটি সুসংগঠিত পরিকল্পনার অংশ, যা তরুণদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করে তাদের আন্দোলন থামিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে চালানো হচ্ছে।
এ সমস্ত হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুরক্ষার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবদুল কাদের বলেছেন:
“যে বিপ্লবীদের কাঁধে ভর দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই বিপ্লবীদের লাশ রাস্তায় পড়ে থাকে। বিপ্লবীদের রক্ত মাড়িয়ে ক্ষমতায় যাওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ ক্ষেত্রে নির্বিকার-নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করছে। এটা অশনিসংকেত।”
চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মী জসিম উদ্দিন হত্যাসহ সাম্প্রতিক হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। তাদের নেতারা দ্রুত হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
জাতীয় নাগরিক কমিটি জানিয়েছে:
“সম্প্রতি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের যোদ্ধারা প্রাণনাশের হুমকি, হামলা ও হত্যার শিকার হচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই অবনতি আমাদের উদ্বিগ্ন করছে।”
তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এই ধারাবাহিক হামলা এবং হত্যাচেষ্টা শুধু একটি নির্দিষ্ট আন্দোলন নয়, বরং পুরো জাতির জন্য অশনিসংকেত। গণতন্ত্র, সুশাসন, এবং তরুণ নেতৃত্বের প্রতি এই আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে তা দেশের ভবিষ্যৎকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই পরিকল্পিত হ’ত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই নিছক ঘটনা নয়, এটি আমাদের তরুণ সমাজকে ভয় দেখিয়ে থামিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র।
সরকার, সুশীল সমাজ এবং নাগরিকদের একত্রিত হয়ে এই সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এখন সময়ের দাবি।