ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন নিয়ে আলোচনা না করার এবং দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার দাবিতে হট্রগোল করে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী পন্থীদের সিন্ডিকেটে ডাকা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আন্দোলন করার সময় ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা উপাচার্যের সাথে এনিয়ে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয়।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের সামনে এই হট্রগোল দেখা যায়।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের সামনে এই হট্রগোল দেখা যায়।
আওয়ামী পন্থীদের ডাকা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে সিনেট ভবনের সামনে শুরুতে শিক্ষার্থীরা এবং পরে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা জড়ো হয়।
এসময় শিক্ষার্থীরা দ্রুত ডাকসু নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানান। অন্যদিকে এখনই ডাকসু নিয়ে কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত না দেওয়ার দাবি জানান ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এবিষয়ে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানের সাথে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয়।
সূর্য সেন হল ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক আবিদুর রহমান মিশু উপাচার্যকে বলেন,ক্যাম্পাসে ছাত্রদল এখনো রাজনীতি শুরুই করতে পারেনি। অস্থিতিশীল এক পরিবেশে বিভিন্ন জন বিভিন্ন ব্যানারে রাজনীতি করছে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো পক্ষের চাপের মুখে অনির্বাচিত সিন্ডিকেট সদস্যদের সভায় এখনই ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
এসময় একদিকে শিক্ষার্থীরা দ্রুত ডাকসু নির্বাচন চেয়ে স্লোগান দেয়। অন্যদিকে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা এখনই ডাকসুর বিষয়ে আলোচনা না করার দাবি তোলে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান সিন্ডিকেটে আওয়ামী পন্থীদের নিয়ে বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে আজকের সিন্ডিকেটে আওয়ামী পন্থীদের রাখা হয়নি। নিয়ম মেনে সিন্ডিকেট থেকে আওয়ামী পন্থীদের অনেককেই বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনিক কার্যক্রমের অগ্রগতির জন্য সিন্ডিকেট সভা করতে হচ্ছে বলে তিনি শিক্ষার্থীদের সহায়তা কামনা করেন।
ডাকসু নিয়ে তিনি বলেন, আজকের সিন্ডিকেট সভার এজেন্ডার মধ্যেই ডাকসু সংক্রান্ত কিছু নেই। ডাকসুর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কমিটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সবার সাথে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সবার ঐক্যমত না হলেও বৃহত্তর অংশের সমর্থন নিয়েই আমরা এগিয়ে যাব।
প্রসঙ্গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী বৈঠক সিন্ডিকেট সভা হয়। এতে আওয়ামী পন্থী তিন সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের সাবেক নেতা অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার, শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও নীল দল নেতা অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভুঁইয়া এবং আওয়ামী লীগ নেতা এস এম বাহালুল মজনুন চুন্নু আমন্ত্রণ পেয়েছেন।
পরে শিক্ষার্থীদের এবং ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ক্ষোভের মুখে তাদের সভা থেকে দূরে রাখা হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রশিবিরের সায়
দীর্ঘ ২৮ বছর পর ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৯ সালের মার্চ মাসে। ওই সংসদের মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের মার্চে। এরপর দীর্ঘ চার বছর ধরে বন্ধ রয়েছে নির্বাচন। বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীরা নির্বাচনের দাবি জানালেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নতুন করে আবার ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি ওঠে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ফেব্রুয়ারির মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে।
নির্বাচন নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যেহেতু ডাকসু নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে, তাই জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারির দিকেই নির্বাচন চায় তারা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু বাকের মজুমদার বলেন, ‘দীর্ঘদিন ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবার সেই আকাঙ্ক্ষা আমরা দেখতে পাচ্ছি।’
আবু বাকের মজুমদার বলেন, ডাকসুর গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রয়োজন, তবে সেটি এককেন্দ্রিক নয়। সংস্কারের জন্য ‘ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির প্রকৃতি ও ধরন’ বিষয়ক যে কমিটি আছে, তারা এটি নিয়ে কাজ করতে পারে। যৌক্তিক সংস্কার হতে হবে। তবে শিক্ষার্থীদের ডাকসুর প্রতি আগ্রহের কারণে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন চায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি আবু সাদিক কায়েমও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে সময়সীমা দিয়েছে, এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। আমরা মনে করি, ডাকসুর যে সংস্কারগুলো প্রয়োজন, সেগুলো এই সময়ের মধ্যেই করা সম্ভব।’
বাম সংগঠনগুলো যা বলছে
ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ জুবেল বলেন, নির্বাচন দেওয়ার আগে কিছু কাজ অবশ্যই করতে হবে। ডাকসুর গঠনতন্ত্রের ক্ষমতা কাঠামোয় পরিবর্তন আনতে হবে। এর গঠনতন্ত্র সংস্কার সবার মতামতের ভিত্তিতে করতে হবে। ডাকসু নির্বাচন হতে হবে অনুষদভিত্তিক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি এই সংস্কারগুলো জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারির মধ্যেই শেষ করে ফেলতে পারে, তাহলে তাঁদের নির্বাচনে যেতে কোনো সমস্যা নেই।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি মেঘমল্লার বসুও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, ডাকসুর সংস্কার ছাড়া নির্বাচন করার কোনো মানে নেই। এবার সংস্কার না হলে আর কখনোই হবে না। সেই সংস্কার যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ফেব্রুয়ারির মধ্যে করতে পারে, তাহলে তাঁদের নির্বাচন যেতে সমস্যা নেই।
নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন সব শিক্ষার্থী ও ছাত্রসংগঠনের প্রত্যাশা—উল্লেখ করে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ বলেন, ২০১৯ সালে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনের আগেও ছাত্রসংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ডাকসুর গঠনতন্ত্রের কিছু সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছিল। ডাকসুর বর্তমান গঠনতন্ত্রে পদাধিকারবলে সভাপতি (উপাচার্য) সব মিটিংয়ের এজেন্ডা ঠিক করে দিতে পারেন, এমনকি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বহিষ্কারও করতে পারেন। এ ধরনের অগণতান্ত্রিক ধারাগুলোর সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। ছাত্র সংসদের সভাপতিও অবশ্যই ছাত্র নেতৃত্বেরই হওয়া উচিত। সারা দেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এমন নির্বাচন বিবেচনা করা যেতে পারে।
সৈকত আরিফ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় যদি ফেব্রুয়ারির শেষেও নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়, তারপরও সংস্কারের জন্য প্রায় দুই মাস সময় পাওয়া যাবে। এটিকে যথেষ্ট সময় বলেই মনে হয়। এসব সংস্কার করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে তাতে তাঁদের আপত্তি নেই। তবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন যাতে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময় হয়, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে।